স্টাফ রিপোর্টারঃ
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া ইউপির মালিয়ানদহ গ্রামের কিশোর ইব্রাহিম আলী। স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। পেটের ডানপাশে ছোট্ট একটুখানি পোড়া দাগ ছিল। সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। কিন্তু সমাজসেবা অধিদপ্তরের তালিকায় সে প্রতিবন্ধী। তাই সরকারি ভাতা পাচ্ছে নিয়মিত। এই গ্রামের মনোয়ারা বেগম বছরখানেক আগে দুর্ঘটনায় ভ্যান থেকে পড়ে ডান হাতের একটি আঙুলে আঘাত পান। তিনি এখন প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী। একই ইউনিয়নের জোতকাদিরপুর গ্রামের ববিতা বেগমের প্রতিবন্ধীর কার্ড আছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, তারা প্রত্যেকেই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। অনুসন্ধানে সরেজমিন জানা গেল, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেনের জাদুর কাঠিতে তারা প্রতিবন্ধী সেজেছেন।
সানোয়ার হোসেন গত বছরের ১২ অক্টোবর বাঘা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত স্ট্রি দায়িত্ব) হিসেবে যোগদান করেন। তার আগে আবদুল হান্নান,নাফিজ শরীফ ও রাশেদুজ্জামান ওই পদে ছিলেন। তাদের স্বাক্ষর জাল (স্ক্যান) করে তিন কিস্তিতে ব্যাকডেটে ৭ শতাধিক ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ড বিক্রি করা হয়েছে এই কার্যালয় থেকে। এই সিন্ডিকেটের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে নেপথ্যে কাজ করেছেন সানোয়ার হোসেন।
ফাঁদে পড়েন অসহায় জনপ্রতিনিধিরা আগের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল
ভুয়া কার্ড বিক্রির অভিনব ব্যবসা।
স্থানীয় রিয়াদ জান মোবারক নামের এক যুবক তার মূল হাতিয়ার, এই ব্যক্তি সহকারী পরিচয় দিয়ে উপজেলা বাসীর কাছে কার্ড বিক্রির জন্য যেতেন। টাকার বিনিময়ে অধিকাংশই সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষকে তারা প্রতিবন্ধী কে সাজিয়ে কার্ড করে দিয়েছেন। অনুসন্ধান চালিয়ে এমন ৭১২টি প্রতিবন্ধী কার্ড হাতে পেয়েছে। এই কার্ডগুলো ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের ইস্যু করা। এসব কার্ডে যখন যে কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, সংশ্লিষ্ট সেই কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে। তবে ভিন্ন সন- তারিখে প্রতিবন্ধী এসব কার্ড ইস্যু হলেও বর্তমান কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেনের সময়ই বিতরণ করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। গত ৫ আগস্টের পর সানোয়ার বাঘা থেকে গোপনে অন্যত্র বদলির চেষ্টা করছেন। বিষয়টি টের পেয়ে তার কথিত এপিএস রিয়াদ মোবারক সানোয়ারের সব ক্যারিশমা ফাঁস করে দেন। রিয়াদকে প্রথমে ‘ফাঁদ’ হিসেবে বাঘার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের কাছে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার ‘শুভেচ্ছাদূত’ হিসেবে চর পাঠানো হতো। সে বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার গরিব-অসহায়দের টাকার বিনিময়ে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ছবি ও ‘ঘুষের টাকা’ এই কর্মকর্তাকে এনে দিতেন। সর্বনিম্ন দেড় হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে করে দিতেন ‘ভুয়া’ প্রতিবন্ধী কার্ড। অনুসন্ধানে টাকার বিনিময়ে উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নে ৪০টি, ৩ মনিগ্রাম ইউনিয়নে ২০, আড়ানি ইউনিয়নে ১৩০, আড়ানী পৌরসভা এলাকায় ১৬০, গড়গড়ী ইউনিয়নে ১৫২, বাজুবাঘা ইউনিয়নে ৪০, চকরাজাপুর ইউনিয়নে ১০টি এবং বাঘা পৌরসভা এলাকায় ১৬০টি প্রায় প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। সব মিলিয়ে ৭১২ জনকে এই ১৪ প্রতিবন্ধী কার্ড দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পাকুড়িয়া ইউনিয়নের মালিয়ানদহ গ্রামের মনোয়ারা বেগম জানান, বছরখানেক আগে দুর্ঘটনায় ডান হাতের আঙুলে আঘাত পেয়েছিলেন। এটি দেখিয়ে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে শারীরিক প্রতিবন্ধীর কার্ড পেয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতার ৭ হাজার টাকাও পেয়েছেন। মালিয়ানদহ এলাকার আমিরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার এলাকায় অনেক অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী মানুষ আছে, অথচ তারা কার্ড পায়নি। কিন্তু ঘুষ দিয়ে অনেক সুস্থ ও সবল মানুষ প্রতিবন্ধী কার্ড করে নিয়েছে। এগুলো কীভাবে হয়!’
বাঘা পৌরসভার সদ্য সাবেক নারী কাউন্সিলর হাজেরা বেগম বলেন, ‘সানোয়ার স্যারের কাছে গত বছর আমি ৫০ জনের কার্ড করে নিয়েছি। ভালো মানুষই সবাই। প্রতিবন্ধী না। এ জন্য তিন হাজার টাকা করে দিয়েছি। স্যার অফিসে টাকা নেয় না। এখানে ফুচকা খেতে খেতে টাকা দিয়েছি। স্যারের সঙ্গে তখন রিয়াদও ছিল। জানা গেছে, গত বছরের ৩১ জুলাই থেকে ১২ অক্টোবর বাঘা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন মো. রাশেদুজ্জামান। বদলি হয়ে বর্তমানে চারঘাট সমাজসেবা কর্মকর্তা। তারও সই নকল করে হয়েছে প্রতিবন্ধী কার্ড।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব কিছুই অনলাইনে এন্ট্রি থাকে। আমি মাত্র সাড়ে ৩ মাস ওখানে (বাঘায়) দায়িত্বে ছিলাম। এই সময়ে যে কার্ডগুলো করেছি, সেগুলোর ডকুমেন্টস আছে। এগুলো ছাড়া যদি আমার স্বাক্ষর কেউ জাল করে কার্ড করে থাকে, তাহলে সেগুলো নিঃসন্দেহে
ভুয়া।’ সানোয়ার হোসেনের এপিএস পরিচয় দেওয়া রিয়াদ মোবারক বলেন, মূলত আমি বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে এসে স্যারকে দিতাম। স্যার কার্ড করে দিলে আমি সেগুলো তাদের কাছে পৌছে দিতাম। এর বিনিময়ে স্যার প্রথম দিকে আমাকে তিন হাজার টাকা মাসিক বেতন দিতেন। পরে ছয় হাজার টাকা, এর পরে ৯ হাজার এবং সর্বশেষ ১১ হাজার টাকা দিতেন। এ ছাড়া তিনি ফরমপ্রতি আমাকে ৫০ টাকা দিতেন।
সব অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বাঘা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘কীভাবে এ কার্ডগুলো হয়েছে তা জানি না। সম্প্রতি অনেকেই অনলাইনে ভেরিফাই করতে আমার অফিসে আসছে, কিন্তু কার্ডগুলো সার্ভারে এন্ট্রি নিচ্ছে না। মানে ভুয়া। কেউ বলতে পারবে না আমি কারও কাছে টাকার বিনিময়ে এ ধরনের কার্ড দিয়েছি’।
বাঘা উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চার কিস্তিতে মোট প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ওই অর্থবছরে সরকারি ভাতাভোগী প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩৩৯ জন। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৮০ জনে। এই অর্থবছরে প্রায় ৭ কোটি টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা বিরতণ করা হয়েছে।