সামছুল ইসলাম অনিক
ইংরেজী Sovereingty বাক্যের অর্থ হলো, সর্বময় কর্তৃত্ব বা সার্বভৌম ক্ষমতা। নিজ দেশের ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব যে দেশের নাগরিকদের রয়েছে, সে দেশের নাগরিকরাই প্রকৃতভাবে স্বাধীন বা সার্ববৌম ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু যদি কোনো চুক্তির মাধ্যমে কোনো দেশ যদি কোনো দেশের অনুগত থাকে, যদি কোনো দেশ চুক্তির মাধ্যমে কোনো দেশের ইচ্ছা ও পরামর্শ অনুযায়ী চলতে বাধ্য হয়, তাহলে ওই দেশকে, ওই দেশের নাগরিকদের পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন বলা যায় না। বাংলাদেশের বাঙালি নাগরিকরা ১৯৭২ সালে পরিপূর্ণ স্বাধীন ছিল না। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সাথে ভারত সরকারের স্বাক্ষরিত সাত দফা ভিত্তিক চুক্তির কারণে তখন বাংলাদেশ ছিল ভারতের অনুগত একটি রাষ্ট্র কিংবা ভারতের এ্যানেক্স। বঙ্গবন্ধু ফিরে না আসলে ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনও বাংলাদেশে অবস্থান করতো। বঙ্গবন্ধু না হলে পৃথিবীর কোন শক্তি ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করাতে পারতো না। যারা অজ্ঞতাবশত অপপ্রচারের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বলেন তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতেন যে, পরাধীনতা কাকে বলে এবং কত প্রকার। ১৯৭৩ সাল থেকে বিগত ৫১ বছর যাবৎ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করা হয়। প্রতি বছর ১০ জানুয়ারী আসলে বিভিন্ন সংগঠনের নেতরা বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করেন। বিভিন্ন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন প্রবন্ধ জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করেন। বিভিন্ন মিডিয়া চ্যানেলে টকশোতে আলোচনা করেন। কিন্তু এ যাবৎ কেউ একবারও বলেননি যে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসতে না পারলে কি পরিণতি হতো বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে সাত দফা ভিত্তিক একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভারত সরকারের পক্ষে একজন কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তির ভয়াবহতা অনুধাবন করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই চুক্তির বিষয়টি আজও জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। প্রবাসী সরকারের অনেকেই জানতেন না। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মরহুম তাজউদ্দিন আহমেদ। এই চুক্তির কারণে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই চুক্তি অগ্রাহ্য করে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। চুক্তি বাতিল করায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি নাখোশ হয়েছিলেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, লোকটা বড্ড জেদী। সাত দফা ভিত্তিক চুক্তির সংক্ষিপ্ত চিত্র ছিল নিম্নরূপ : ১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে চূড়ান্ত লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী সহ-প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পাবেন না। ২. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এমন সকল সরকারী কর্মকর্তাদের চাকুরী থেকে অবসর দেয়া হবে। অভিজ্ঞ কর্মচারীর শূন্যতা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। ৩. বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। আভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে। (এটি রক্ষীবাহিনী নামে পরিচিত ছিল)। ৪. বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী অবস্থান করবে। স্বাধীনতার পর নভেম্বর মাস থেকে এর কার্যক্রম শুরু হবে এবং প্রতিবছর নভেম্বর মাসে পর্যবেক্ষণ করা হবে। ৫. পররাষ্ট্র বিষয়ে ভারত যা বলবে, তাই মেনে নিতে হবে। ৬. সাউথ ব্ল¬কের এ্যানেক্স হবে সেগুন বাগিচা। ৭. উভয় দেশের সীমান্তের তিন মাইল জুড়ে চালু করা হবে খোলা বাজার। বছর শেষে হিসাব-নিকাশ করা হবে। প্রাপ্য মেটানো হবে পাউন্ড স্টালিং এর মাধ্যমে। সাত দফা ভিত্তিক ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিংবা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী অংশগ্রহণ করেননি। সাত দফা ভিত্তিক চুক্তির কারণেই তারা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেননি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন যে, বাংলাদেশ পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন নয়। সাত দফা ভিত্তিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশ হয়েছে ভারতের এ্যানেক্স। সাত দফা ভিত্তিক চুক্তি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা বঙ্গবন্ধুর জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি মন্ত্রীসভায় বললেন, এই চুক্তি আমি মানি না। একে একে সব সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিলেন। ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চলে যেতে বললেন। মুক্তিযুদ্ধ করেনি এমন সব সরকারী কর্মকর্তাদের চাকুরী থেকে অবসর দেয়ার বিপক্ষে মত দিলেন। পররাষ্ট্র বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিন মাইলের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। রক্ষীবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত মানলেন। তবে সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে মত দিলেন। সেনাবাহিনী রাখা না রাখার বিষয় নিয়ে মন্ত্রীসভার বৈঠকে তুমুল বিতন্ডা হয়। একপক্ষ বলেছিলেন, অতীত অভিজ্ঞতার কারণে সেনাবাহিনী রাখার দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সেনাবাহিনী থাকবে। তাজউদ্দীন আহমেদসহ মন্ত্রীসভার বেশ কয়েকজন সদস্য ক্ষুব্ধ হন। চুক্তি বাতিল করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে। অসংখ্য মা-বোন সম্ভ্রম বিনষ্ট করে পাকিস্তানের গোলামী থেকে মুক্তিলাভ করেছে। এক গোলামী থেকে মুক্তিলাভ করে আমি আর এক গোলামীর জিঞ্জির গলায় পরতে পারব না। এ সময় বাংলাদেশী মুদ্রা ভারতে মুদ্রণ করা হয়েছিল।