আব্দুল্লাহ আল মামুন (শের ই গুল)
প্রকাশক ও সম্পাদক
দৈনিক আমার প্রাণের বাংলাদেশ
পেশা হিসেবেও দেশে সাংবাদিকতা যে একেবারে নেই তা নয়। এখনো অনেক শিক্ষিত, মার্জিত এবং আদর্শবান ব্যক্তি এই পেশা আঁকড়ে আছেন। তারা সাহসিকতা, নির্ভীকতা ও সত্যের জন্য লড়াকু। তাদেরই স্নেহ আর ভালবাসার প্রেরণায় ‘অনেকেই পথ হাঁটছি সংবাদপত্রের পথে’। কিন্তু অপসংবাদিকদের চাপাবাজি কা-কা বাচাল শব্দের মিথ্যাচারীতায় সত্যিকারের সাংবাদিকরা অস্থির হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে আটাশির বন্যা-পরবর্তী ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন সভায় যোগ দিতে দক্ষিণাঞ্চলের এক গ্রামে যেতে হয়েছিল একটি পাক্ষিক পত্রিকার (শিক্ষানবিস প্রতিবেদক) হয়ে। ঐ সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ছিলেন। একটু দূর থেকে যেতে হয়েছিল বলে পৌঁছাতে খানিকটা দেরি হয়। সে যাই হোক, কোনো রকমে সভার পেছনে দাঁড়িয়েই বিষয়বস্তু লিখতে মনোযোগ দিলাম। কিন্তু ততক্ষণে আশপাশে কানা-ঘুষা শুরু হয়ে যায়। ‘সাংবাদিক-সংবাদিক’ বলে কয়েকজন পাশে ভিড় জমান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনের দিক থেকে কয়েকজন এসে নিয়ে যান সভামঞ্চে। সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। বসানো হলো তাদেরই মধ্যে । তখন বয়স বলতে সবে ২১। গড়ন রোগা-পাতলা, আবার খাটোও। এই অবস্থায় নিজেকে বেশ বেমামান লাগছিল তখন। লজ্জ্বায় মাথা নুয়ে এসেছিল।
২০০৯ সালের শেষের দিকে ঢাকার মৌচাক মার্কেট এলাকা। বন্ধু (প্রয়াত) ইত্তেফাকের কালাম ভাইয়ের বাইকে করে শিল্পকলায় যাওয়ার সময়, কি একটা জিনিস দেখে সেবিকা রানী মন্ডল বাইক থামালেন ফুটপাতের একটা দোকানের সামনে। তার কাঁধে তখন ‘ইয়া বড়’ ক্যামেরা ঝুলছিল। জিনিসটা দেখার সময় দোকানি প্রশ্ন করে উঠলেন ‘মামা কি সাম্বাদিক’? উত্তরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে প্রেস লেখা একটা কার্ড বের করে দেখিয়ে বললেন, ‘আমিও কিন্তু ‘সাম্বাদিক।’ কীভাবে এবং পড়াশোনা কতটুকু এই প্রশ্নের জবাব-‘আরে আমার মামা বড় সাম্বাদিক-পত্রিকার ছম্পাদক’ ৫০০ টাকা আর একটা ছবি নিয়া কইলেন-পরে দেখা করিস। কয়দিন বাদে গেলে এই কার্ড খান হাতে ধরাইয়া দেন-কন ‘নে তুই এহন থেইক্কা সাম্বাদিক, ত’রে আর পুলিশে দৌড়াইবো না-একখান জিনিস দিলাম।’ তয় আমি তো পড়ালেহা জানি না, কি লিখমু-কইলে তিনি কন এইডা লাগবো না আমি আছি না!
সংবাদ এবং সাংবাদিকতা ঐ দুই দশকে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা এই দুটি ঘটনাই বলে দেয়। আজকে ঐ ঘটনার ঠিক নয় বছর পর অবস্থা আরো এগিয়ে এনেছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল।
অথচ আগে সাংবাদিকতা শিক্ষানবিস হিসেবে এবং এই পেশার সঙ্গে দীর্ঘ সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমেই শিখতে হতো। চট করে আমিও ‘সাম্বাদিক’ মানে সাংবাদিক বলা যত সহজ, আসলে যিনি এই পেশায় নিয়োজিত আছেন (প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে) তার কাছে মোটেও সহজ নয়।
আমাদের দেশে এখন সাংবাদিক নয়, ‘সাম্বাদিক’র ছড়াছড়ি। ফুটপাতে, বাসে শব্দটা শুনতে শুনতে একটা বাজে ধারণা জন্মায় যে কারো। এমনও দেখা গেছে বাসভাড়া চাইলে বলে ওঠেন ‘যা ভাড়া লাগবো না।’ কেন লাগব না-এই প্রশ্ন বাসের লোকজন করলে সগৌরবে ‘সাম্বাদিক’ শব্দটা বলে ফেলেন। কিংবা মোটরসাইকেলের সামনে প্রেস লিখে রেখে চলেন দাপটের সঙ্গে। কিন্তু সাংবাদিকতা যে এমন সব কর্মকাণ্ড কে বৈধতাই দেয় না-তা কি কারো জানা আছে!
এ বিষয়ে সাংবাদিক এমভি কামাথ তার ‘প্রফেশনাল জার্নালিজম’ গ্রন্থে সংবাদের ৪টি বৈশিষ্ট্যের কথা লিখেছেন। এগুলো হচ্ছে, সময়পোযোগিতা, নৈকট্য, আয়তন ও গুরুত্ব। আর ভারতীয় সাংবাদিক পতঞ্জলী শেঠি এই চার বিষয়ের সঙ্গে মানবিক আবেদন ও অস্বাভাবিকতাকে যুক্ত করেছেন।
তবে অনেকেই জানি, সাংবাদিকতা হচ্ছে একটা আদর্শ। এই শব্দটার মধ্যেই ন্যায়, সত্য, ধৈর্য, সহমর্মিতা, সাহসিকতা, যোগ্যতা এবং মানবিক গুণাবলি রয়েছে। আলাদা করে মানবাধিকারের কথা কিংবা বস্তুনিষ্ঠতা বলার অপেক্ষা থাকে না। কিন্তু দেখছি অনেক ভুঁইফোড় সাংবাদিক বিভিন্ন নামে মানবাধিকার সংগঠন খুলে চারদিকে প্রতারণার জাল ছড়িয়ে রেখেছেন। এদিকে কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিকতা কিংবা পেশাগত দক্ষতা না থাকায় অনেকে আছেন যারা অনুবাদ তো দূরের কথা, বাংলাতেও একটা প্রতিবেদনের শুরুটাও ঠিক করে লিখতে পারেন না। বলতে কষ্ট হয়-তারাই আজকাল অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে মাথা চিবিয়ে খাচ্ছেন পেশায় দক্ষতা অর্জনকারী সহকর্মীর (কাউকে খাটো করার জন্য নয়)। এটা কি লজ্জা এবং অপমানের নয়? আর এ কারণেই অনৈতিক চর্চাও বাড়ছে। এখন সম্পাদক, মালিক ও সাংবাদিকের কারাবরণ; অর্থদণ্ড ও জরিমানা, প্রেস বাজেয়াপ্ত হওয়া, পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়া এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
আবার সাংবাদিকদের জন্য বাংলাদেশের যত সরকার এসেছে প্রায় সব সরকার বিশেষ করে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে সাংবাদিকরা যে পরিমাণ পা চেটেছে তা কল্পনারও অতীত। সাংবাদিকদেরকে অনুগত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অজুহাতে যেমন অসুস্থ কিংবা বেকার হলে মিলছে আর্থিক অনুদান, যা স্বয়ং সাংবাদিকদের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কেউ কেউ পেয়েছেন জমি এমনকি বাসস্থানও। এটা কী কম পাওয়া? এসব দিয়ে ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন সময় লোভী সাংবাদিকদেরকে কুকুরের মত গোলাম বানিয়ে নিজের চারিদিকে রেখেছে আর তারাও লেজ লেড়েছে আর মালিকের আনুগত্য করেছে ।
সংবাদপত্র এবং এর নীতি নির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন ইহ জীবনে কি সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার উপর সুন্দর কোন আইন প্রণয়ন হবে কিনা? শিক্ষার মূল্যায়নে সাংবাদিকতার মর্যাদা সিঁড়ি পাবে কিনা?
ইতিহাস বলে, মুঘল আমলের বাংলায়ও সাংবাদিকতা ছিল। তবে তা শুরুর পর্যায়ে। প্রাচীন ভারতে পাথর বা স্তম্ভে খোদিত শব্দাবলি তথ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সম্রাট অশোক পাথর ও স্তম্ভে খোদিত আদেশ তার সাম্রাজ্যের সর্বত্র এবং বাইরেও প্রজ্ঞাপন করেন। তিনি তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশে এবং বিদেশে গুপ্তচর নিয়োগ করেন। সুলতানি আমলে ‘বারিদ-ই-মামালিক’ বা গোয়েন্দা প্রধান কর্তৃপক্ষকে সাম্রাজ্যের তথ্য সরবরাহ করার দায়িত্ব পালন করতেন। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির মুনহি বা গুপ্তচররা সুলতানকে অতি তুচ্ছ বিষয়গুলোও অবহিত করত। মুঘল শাসনামলে সংবাদ সার্ভিস নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘ওয়াকই-নবিশ’, ‘সাওয়ানিহ-নবিশ’ এবং ‘খুফিয়ানবিশ’ চালু ছিল। এ ছাড়াও ‘হরকরা’ এবং ‘আকবর-নবিশ’ নামে সুলতানদের সাধারণ তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল। ভাট, কথক এবং নরসুন্দর মানুষকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক খবর জানাত। আধুনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সাংবাদিকতার উৎপত্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে। উপনিবেশ হওয়ার কারণে এশিয়ার অন্য যে কোনো দেশের আগেই বাংলা অঞ্চলে সাংবাদিকতা শুরু হয়। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত জেমস অগাস্টাস হিকির বেঙ্গল গেজেট প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলায় আধুনিক সাংবাদিকতার ইতিহাস শুরু হয়। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, সব পক্ষের জন্য উন্মুক্ত হলেও এটি কারও দ্বারা প্রভাবিত নয়-এমন একটি সাপ্তাহিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পত্রিকা।
১৮১৮ সালে বাংলা সাংবাদিকতা যাত্রা শুরু করে। সে বছর বাঙাল গেজেট (কলকাতা), দিগদর্শন (কলকাতা) এবং সমাচার দর্পণ (শ্রীরামপুর) নামে তিনটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম বাংলা সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান ভূ খন্ড-থেকে প্রথম প্রকাশিত সাপ্তাহিক রংপুর বার্তাবহ প্রকাশিত হয় রংপুর থেকে ১৮৪৭ সালে এবং ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঢাকা নিউজ প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালে। ঢাকা প্রকাশ ১৮৬১ সালে এবং ঢাকা দর্পণ ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
বিশ শতকের শুরুতে সাংবাদিকতা পেশা এক নতুন মোড় নেয়। জাতীয়বাদী আন্দোলন, মুসলিম জাতীয়তাবাদের উত্থান, প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের সূচনা প্রভৃতি কারণে সংবাদপত্রসমূহের চাহিদা ও পাঠকসংখ্যা দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং পূর্ববাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার উত্থান সাংবাদিকতার বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
এখন সংবাদমাধ্যমের পরিধি বাড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। দেশের ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৬-৭টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ইনস্টিটিউট ও সেন্টারে সাংবাদিকতা শিক্ষা/প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) দীর্ঘকাল ধরে প্রশিক্ষণের কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যাস কমিউনিকেশন এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
সাংবাদিকদের সাধারণ এবং শাখাভিত্তিক ইউনিয়ন বা সংস্থা রয়েছে। কেবল পেশাগত স্বার্থে সহায়তাই নয়, সাংবাদিকতার নৈতিকতা এবং পেশাগত সম্ভাবনা উন্নয়নের জন্যও সাংবাদিক সংগঠনগুলো ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকতার পেশাগত নৈতিকতার দিকটি দেখভাল করে। এরপরও ‘সাম্বাদিক’দের ছড়াছড়ি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে সংবাদমাধ্যমের জন্য চরম দুঃসংবাদ শোনার অপেক্ষায় থাকতে হবে। যদিও বর্তমানে লিখিত সংবাদমাধ্যমে (প্রিন্ট মিডিয়া) এক রকম দুর্দিন যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এ সংবাদমাধ্যমের টিকে থাকা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। এ সংশয়ের মধ্যেই আশার খবরও শুনি চারদিকে। দেশ সংস্কার করার মত রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার করার মত সাংবাদিক নাকি সংস্কার হবে। আমরাও দেখি কি হয়, কত কিছুই তো এ জীবনে দেখলাম অপেক্ষায় থাকলাম দেখি কি হয়, নতুন কোন সংস্কারে যদি কোন ভাবে টিকে যাই তাহলে হয়তো সাংবাদিকতা করা যাবে, নয়তো আখের গুছিয়ে অন্য কিছু করার চিন্তা করতে হবে ।