গাজীপুর প্রতিনিধি:
একসময়ে পুলিশের সোর্স হিসেবে ব্যবহৃত আনোয়ার হোসেন সৌরভ বর্তমানে পরিণত হয়েছে গাজীপুরের মস্তবড় সাংবাদিক। যখন পুলিশের সোর্স বা তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করেছে সে সময়ের রপ্ত করা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বেড়াচ্ছে সে। ফলে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করা তার পক্ষে হয়ে ওঠে সহজসাধ্য। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককে মোটা অংকের টাকা দিয়ে কিনে নেন পত্রিকার আইডি কার্ড। হয়ে উঠেন মস্তবড় সাংবাদিক। অতীতের সোর্সের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন সে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয়ে জাহির করেন। করে বেড়ান একের পর এক অপরাধ কর্মকান্ড। প্রশ্ন হচ্ছে, কখনো পুলিশের সোর্স, কখনো গাজীপুর জজ কোর্টের মহোরী, কখনো আবার সাংবাদিক, কখনো পুলিশ এস.আই(দারোগা) নানা অভিযোগে অভিযুক্ত কথিত নামধারী সাংবাদিক পরিচয়দানকারী সৌরভের খুঁটির জোর কোথায়?
তার বিরুদ্ধে এখনই প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে দাবী করেন সচেতন মহল। জানা যায়, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে টঙ্গী পশ্চিম থানায় পুলিশের সোর্সের কাজ করতেন আনোয়ার হোসেন সৌরভ (৩১) সে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার মুকশোপুড় গ্রামের আব্দুল আউয়ালের ছেলে। ২০১৮ সালে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গী পশ্চিম থানায় শুরু করেন পুলিশের সোর্সের কাজ ও মামলা লেখার কাজ, সেই সময় তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকার একাধিক বাসিন্দাদের কাছ থেকে। নানান অপরাধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় সেখানেও খুব বেশি দিন ঠায় হয়ে উঠেনি তার। টঙ্গী পশ্চিম থানা থেকে যায়গা বদল করে তিনি চলে আসেন গাজীপুর মহানগরের সদর থানার সাহাপাড়া (হাজীপাড়া) এলাকায়।
পুলিশকে দেওয়া বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদানে হয়ে উঠেন ভয়ঙ্কর সোর্স। এখানেও এসে শুরু করেন রাইটারের কাজ। সোর্স ও রাইটিংয়ের কাজের সুবাদে সদর থানার পুলিশ অফিসারদের সাথে গড়ে উঠে তার সখ্যতা। এই সুযোগে তিনি নিজেকে পুলিশের এসআই দাবি করে বিভিন্ন লোকজনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করতে থাকেন এমনও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের নেপথ্যে সৌরভ: গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন থানার এসআই/এএসআইদের বিরুদ্ধে জিএমপি কমিশনার বরাবর একের পর এক অভিযোগের নেপথ্যে রয়েছেন কথিত সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সৌরভ। সম্প্রতি সৌরভের যোগসাজসে টঙ্গী পশ্চিম থানার এস.আই তৌফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা নাটক সাজিয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন সুমন নামের এক সবজি বিক্রেতা।
অভিযোগে বলা হয় টঙ্গী পশ্চিম থানাস্থ সাতাইশ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ মোড়ে ভাসমান ব্যবসায়ী সুমনের কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা নেন এসআই তৌফিক। এতে চারজনকে স্বাক্ষী করেন সুমন। এব্যাপারে অভিযোগকারী সুমনের সাথে যোগাযোগ করলে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। অভিযোগের ১ম সাক্ষী টঙ্গী সাতাইশ এলাকার জসিম উদ্দিন বলেন, আমি আপনার কাছ থেকে জানলাম, আমাকে আগে কেউ জানায় নি যে আমি কোন অভিযোগের সাক্ষি। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জসিম বলেন, সুমনের স্ত্রী শারমিন আমার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ধার হিসেবে নেয়। কিন্তু সেই ধারের টাকা কেন বা কাকে দিবে সেটা আমাকে বলে নাই। আরেক সাক্ষী শেখ আহমেদ বলেন, স্যার আমি তো ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে চিনিই না। তার সাথে আমার কখনো দেখাই হয় নি। কেন আমাকে অভিযোগের সাক্ষী করা হয়েছে তাও আমার জানা নেই।
অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা তৌফিক ইসলাম বলেন, এবছরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দিন ৮ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সাতাইশ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মোড় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে যানযট নিরসন ও ফুটপাত মুক্ত করতে সঙ্গীয় ফোর্স কনস্টেবল ইদ্রিসসহ ডিউটি করি। এমতাবস্থায় মসজিদ মোড়ে দুটি ভ্যানগাড়ি একসাথে থাকা অবস্থায় তাদেরকে সরে যেত বলি। অন্যথায় ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রেতা সুমন বলে আমি এখানে স্থায়ী ভাবে ব্যবসা করি। এখান থেকে সরবো না। পরবর্তী আমি সেখান থেকে চলে আসি। ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রিতার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কোন প্রশ্নই উঠেনা। অভিযোগকারী অন্যের প্ররোচনায় বাংলাদেশ পুলিশের মতো একটি পেশাদার বাহিনীর ব্যক্তির ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করার অসৎ উদ্দেশ্যে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটি করেছেন।
আনোয়ার হোসেন সৌরভের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: গাজীপুর মহানগরের বিভিন্ন থানা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবী, মহানগরের বিভিন্ন মাদক স্পট থেকে মাসোয়ারা আদায়, সুন্দরী নারী মাদক ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলা, এরপর পরকিয়া প্রেমসহ একাধিক নারীদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে থাকেন এই সৌরভ। এখানেই শেষ নয়, একসময়ের পুলিশের সোর্স পরিচয়ে পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে জনসাধারণকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিতেন মোটা অংকের অর্থ। বর্তমানে কথিত এই সাংবাদিক সৌরভ মাদক কারবারিদের কাছ থেকে পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে মোটা অংকের অর্থ দাবি করেন। অর্থ না দিলেই শুরু হয় সাংবাদিক পরিচয়ে সংবাদ প্রকাশের হুমকি। তাকে অর্থ দিলে বিনা অপরাধীকেও অপরাধী বানানো যায় বলেও জানা গেছে।
তার এসব অপকর্মে বাধা দিতে গেলেই পুলিশ কর্মকর্তারা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাড়ায়। যার কারণে কখনো সদর থানা পুলিশের এসআই/এএসআই, আবার কখনো টঙ্গী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে একর পর এক বিভিন্ন বিবাদীকে কব্জায় নিয়ে সাজানো বক্তব্য তৈরি করে অভিযোগ দায়ের করা হয়। যার নেপথ্যে রয়েছেন পুলিশের সোর্স ও কথিত সাংবাদিক সৌরভ। তার এহেন কর্মকান্ডে পুলিশ কর্মকর্তারা বিব্রত। যা কিনা বাংলাদেশ পুলিশ তথা গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার এক ঘৃণ্য অপতৎপরতা। এদিকে সালনা ইপসা এলাকা থেকে কল্পনা নামের এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, আমার মেয়ে কিস্তি থেকে টাকা তুলে ঘরের আলমারিতে রেখে দেন। বিষয়টি কিভাবে টের পেয়ে রাতের বেলা বাথরুমের উপর দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেন সৌরভ,পরিচয় দেন তিনি সদর থানার দারোগা। এরপর বিনাঅনুমতিতে ঘরে প্রবেশ করে তল্লাশি করে আলমারিতে রাখা ৪২ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায় সৌরভ।
অন্যদিকে সালনার অটোরিকশা চালক স¤্রাট অভিযোগ করে বলেন, পুলিশের সোর্স আনোয়ার হোসেন সৌরভ পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে ডাম্পিং থেকে অটোরিকশা ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে ১২’শত টাকা নেয়। প্রথমত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সে আমাকে নানা ভাবে হয়রানি করে। আমি এর সুষ্ঠ বিচার চাই। আরেক ভুক্তভোগী শহরের ছায়াবীথি এলাকার বাসিন্দা শাহিনা বলেন, আনোয়ার হোসেন সৌরভ আগে পুলিশের সোর্সের কাজ করতো। এখন সে নিজেকে বড় মাপের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বেড়ায়। আমার এক ভাতিজার সাথে পরিচয়ের সুবাদে নিয়মিত আমার বাসায় আসা যাওয়ার করত। তারপর হঠাৎ একদিন এক মেয়ে নিয়ে আমার বাড়িতে উঠে পড়ে। আমি বাধা দিলে সৌরভ বলে আমার কথা শুনলে সব রকম সুযোগ সুবিধা পাবেন। অন্যথায় ওই নারীকে রিকোভারি দিয়ে থানার ভিতরে ভরে দেওয়ার হুমকিসহ ওই নারীকে প্রায় সময় কু-প্রস্তাব দিত সৌরভ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাহাপাড়া(হাজীপাড়া)এলাকার স্থানীয় একজন বলেন, এই ছেলেটা একসময় দেখতাম পুলিশের পিছনে ঘুরে সোর্সের করতো। এখন দেখি সে কোমড়ে সাংবাদিকের আইডি কার্ড ঝুলিয়ে চলাফেরা করে। তার চলাফেরা দেখলে মনে সে এখন বড় সাংবাদিক। এখন সে সাংবাদিক পরিচয়ে নানাভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেন। বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে। তার ভয়ভীতি প্রদর্শনে রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত গাজীপুর শহর এলাকার অনেক অসহায় মানুষ। এছাড়াও তিনি পুলিশ সদস্যদের অজান্তে নিজেকে তাদের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে বলে অনেক অসহায় মানুষের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন বলেও জানান। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সৌরভ বলেন, আমি গাজীপুর জজ কোর্টের মহোরী ছিলাম।
পুলিশের সোর্স কখোনই ছিলাম না। মাদক ব্যবসায়ীদের টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যখন মহোরী ছিলাম মাদক ব্যবসায়ী, চোর ছিনতাকারীরা যখন আদালতে হাজিরা দিতো তখন জামিন করার জন্য তাদের কাছ থেকে টাকা নিতাম। আমার কার্ড নাম্বার-৪৪৬। সুন্দরী নারী মাদক ব্যবসায়ীদের সখ্যতা গড়ে ব্ল্যাকমেইল করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নারীদের সাথে এরকম তো করার প্রশ্নই উঠেনা। এরকম কোন তথ্য থাকলে পুলিশকে দেন। আমার বিরুদ্ধে নিউজ করেন। সৌরভ আরো বলেন, ভাই আমার বউ গেছেগা, আমি দেবদাসের মত জীবন যাপন করি, সারাদিন বাসায় থাকি, ঘর থেকে কোথাও বের হই না। গত এক বছর ধরে ব্যাক্তিগত মানসিক ভাবে আমি হেয় প্রতিপন্ন।