উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে যোগদানের পরই আলাদিনের চেরাগের সন্ধ্যান পান অফিস সহকারী সুমন। অফিসে যান এস করোলা গাড়ি নিয়ে। ঢাকায় যাতায়াত করেন আকাশ পথে। সরকারি নিয়ম বহির্ভূতভাবে অফিসে লাগিয়েছেন নেইম প্লেট। চলাফেরা করেন রাজকীয়হালে, অফিসে আসা যাওয়া করেন ইচ্ছামাফিক।
মো: সুমন আহমদ অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে ২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে যোগদান করেন। প্রথম তাকে পদায়ন করা হয় হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলায়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে বদলি করা হয়। অদ্যবধি সেখানেই কর্মরত আছেন।
৫ বছর যাবত একই পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন একই জেলার রাজনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে। দুই উপজেলায়ই গড়ে তোলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বিশেষ করে রাজনগর উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়ার পরই শুরু হয় তার উত্তান। অনিয়ম করে ইতিমধ্যে মালিক হয়েছেন অঢেল সম্পদের।
স্থানীয় জাতীয় সংসদ সদস্যকে নিকট আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তিনি এসব অনিয়ম করেছেন বলে জনস্রোত রয়েছে। জানা যায়, ২০১৫ সালে সরকারি চাকুরির পূর্বে তিনি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে অস্থায়ী ভিত্তিতে দেড় বছর কাজ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার রাজনগর উপজেলায় টিআর, কাবিখা, কাবিটা (সাধারণ ও বিশেষ) নগদ অর্থ ও খাদ্যশস্য প্রকল্পের বিলে পিআইসি কমিটির সভাপতির জাল স্বাক্ষর দিয়ে টাকা উত্তোলন করেন সুমন। আবার অনেক প্রকল্পে ভূয়া পিআইসির সভাপতি দেখিয়েছেন। টিআর প্রকল্পে পিআইসি কমিটির সাথে ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি করার কথা থাকলেও করা হয়নি।
অথচ পিআইসি কমিটির কাছ থেকে স্ট্যাম্পের টাকা নেয়া হয়। নানা কৌশলে পিআইসি কমিটির কাছ থেকে ১৫/২০ শতাংশ টাকা উৎকোস আদায় করেন সুমন। রাজনগর উপজেলায় মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সুমন। সুমন ফজলু নামে এক মেস্তরি দিয়ে সব কাজ করান।
ঘর নির্মাণে ব্যবহার হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী। অনুসরণ করা হয়নি নির্ধারিত ড্রয়িং। উপকারভোগীরা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। নামকাওয়াস্তে কাজ করে বায়েরা চেকের মাধ্যমে নামে বেনামে টাকা উত্তোলন করা হয়। ঠিকাদার ফজলু মিয়া বলেন, “সুমন স্যারের মাধ্যমে কাজ করেছি। উনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবে করেছি। শ্রমিকদের মজুরি সুমন স্যারের কাছ থেকে নগদ এনেছি। চেকের মাধ্যমে কোনো টাকা পাইনি।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সরকারি/বেসরকারি এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম ও সামাজিক কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে বরাদ্দকৃত চালে রাজনগর ও জুড়ী উপজেলায় অনিয়ম করেছেন সুমন। প্রতি প্রতিষ্ঠানকে ২ মেট্টিক টন চালের বিপরীতে কাউকে দেয়া হয়েছে ১০ হাজার আবার কাউকে ২০, ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
অথচ তৎকালিন সময়ে বাজার মূল্য ছিল ৮০/৯০ হাজার টাকা। রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি আতাউর রহমান বলেন, এমপি মহোদয়ের অনেক প্রকল্প আমার ইউনিয়নে হয়েছে। প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে সুমন প্রায় সময় ইউএনও ও পিআইও অফিসারদের দোহাই দিয়ে টাকা চাইতে শুনেছি। নাম গোপন রাখার শর্তে রাজনগর উপজেলার একাধিক ইউপি সদস্য বলেন, “প্রত্যেক কাজের জন্য সুমনকে ১৫/২০ পার্সেন্ট কমিশন দিতে হয়। টাকা না দিলে নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হয় এবং সময়মতো বিলও পাইনি”।
রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: সিরাজুল ইসলাম ছানা বলেন, আমার ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের জন্য স্ট্যাম্প ও অন্যান্য খরচ বাবত ৪/৫ হাজার টাকা দিয়েছি। জুড়ী ও রাজনগর (অতিরিক্ত দায়িত্ব) উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সুমন আহমদ বলেন, দুই উপজেলায় দায়িত্ব পালন করি বিদায় কাজে ভুলত্রুটি হতে পারে।
কিন্তু আমার জানামতো এমন ত্রুটি করিনি যার কারণে সরকারের উন্নয়নে ব্যঘাত হয়েছে। যে বা যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন তা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এস করোলা গাড়ি চালিয়ে আপনি অফিসে যান এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমার ছোট ভাইর।
জুড়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: মিজানুর রহমান বলেন, সে মাষ্টার রোলের খরচ বাবত চেয়ারম্যান/ইউপি সদস্যদের কাছ থেকে টাকা নেয়, তবে এটা নির্ধারিত নয়। সে অফিসে আসে দুপুর ১২/১টায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটু দেরিতে আসে, কিন্তু ১১টার মধ্যে চলে আসে। অপর একটি অভিযোগে জানা যায় ময়মনসিংহের বেশ কয়েকটি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে কোটি, কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের রয়েছে ময়মনসিংহ নগরীর চড়পাড়া, নতুন বাজার, ভাটিকাসর এলাকায় আলিশান ফ্ল্যাট ও বাড়ি।