মো,জাকারিয়া
নরসিংদী প্রতিনিধি
পাঠ্যবই ছাপার কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কোটি কোটি শিক্ষার্থী ও সরকারকে জিম্মি করে রেখেছিল বড় বড় সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ধরতে বৈষমবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কসহ অর্তবর্তী সরকারের প্রতিনিধি তৎপর রয়েছে। এরই ধারাবাহিতায় নরসিংদীর মাধবদী থানাধীন মেহেরপাড়া ইউনিয়নে চৈতাব গ্রামে মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেডের কারখানায় অভিযান চালিয়ে জব্দ করে বৈষমবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতাসহ জেলা প্রশাসন ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে এ অভিযান চালানো হয়। এ সময় বিপুল পরিমাণ কাগজ অবৈধ্য মজুদের দায়ে মিলটিতে এখনো পুলিশ পাহারা রয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে তদন্তে নামেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, মিলের প্রধান ফটকের সামনে মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেড এর ম্যানাজার পরিচয় দিয়ে কথা বলেন দেলোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি তিনি বলেন, শুক্রবার রাতে ৫০জন সমন্বয়ক এসেছে তাদের সাথে আমরা কি বলো, তাদের এখনো দাড়িমুছ জ্বালাইনি, বাচ্চা মানুষ। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সবাই বসে ছিলো, আমাদের সব কাগজ বৈধ আছে। আমরা একটি প্রতিষ্ঠানের অর্ডার পেয়ে এখানে বইয়ের মোড়ক ছাপানোর কাজ করছি। আমাদের অবৈধ কোন কাজ করা হচ্ছে না। আমাদের কাগজপত্র সব পাঠানো হয়েছে দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শুক্রবার রাত থেকে এখনো ওই মিলে নরসিংদী পুলিশ লাইনের কয়েকজন রিজার্ভ পুলিশ সদস্য মাস্টার সিমেক্স পেপার লিমিটেড প্রধান ফটক ও ড্রিম হলীডে পার্কের সামনে একটি গোডাউনের ভিতর অবস্থান করছেন। সংবাদকর্মীদের ভিতরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
শনিবার রাত ৮টার দিকে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী, পুলিশ সুপার মো.আব্দুল হান্নান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আছমা সুলতানা নাসরিন সহ সংশ্লিষ্টরা মিলে পুনরায় তদন্তে আসেন। তবে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্য দেননি প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা।
এর আগে মুঠোফোন কথা হলে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, শুক্রবার দিবাগত রাতে জেলা পুলিশের সহযোগিতায় মিলটিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযান চালায়। অবৈধ্য মজুদের ফলে মিলটিতে পাহাড়া বসানো হয়েছে। তবে বিস্তারিত সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানাতে পারবেন।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে নরসিংদী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, 'বিষয়টা সুরাহা হয়ে যাবে। আর বইটা যেন যথা সময়ে আসতে পারে বাজারে, কোন ব্যবসায়ি যেন কাগজ স্টক করে না রাখতে পারেন। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা রয়েছে। আর এখানে কাগজ স্টক রয়েছে। এমন অভিযোগে শুক্রবান রাতে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করেন।
এ অভিযানে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে নরসিংদী জেলা প্রশানসনের পক্ষ থেকে রাজীব দাশ নামে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক নাজমুস সাকিবসহ আরো কয়েকজন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, ছাপার জন্য তাদের যত কাগজ দরকার অধিক মুনাফার আশায় তার চাইতে অনেক বেশি কাগজ মজুদ করে রেখেছিল মিলটি। সরকারের তরফে বারবার সতর্ক করার পরও কানে নেয়নি তারা। পরে শুক্রবার রাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও কয়েকজন সমন্বয়ক অভিযান চালিয়েছে গাজীপুরের মাস্টার সিমেক্সের গোডাউনে। জব্দ করেছে পাঠ্যবই ছাপার আর্ট কার্ড। এরপর নরসিংদীতে মাস্টার সিমেক্সের পেপার লিমিডিটেড মিলে অভিযান চালায় প্রশাসন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সমন্বয়করা বলছেন, পাঠ্যবই ছাপার কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কোটি কোটি শিক্ষার্থী ও সরকারকে জিম্মি করে রেখেছিল একটা সিন্ডিকেট।
এই কাগজগুলো মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করা। এগুলো দিয়ে পাঠ্যবইয়ের কভার পৃষ্ঠা করা হয়। মাস্টার সিমেক্স পেপারস লিমিটেড প্রতিবছর এই কাগজ এনে মজুদ করে। তারপর বই ছাপার সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তারপর বেশি দামে বিক্রি করে সরকারের কাছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকারের সংস্কারের অংশ হিসাবে আগের শিক্ষাক্রম স্থগিত করে ২০১২ এর শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই পরিমার্জন করা হয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীরা এসব বই হাতে পাওয়ার কথা থাকলেও তা ছাপাখানার মালিকদের ঢিলেমিতে ভেস্তে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। গত ৫ আগস্ট রজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে এবার ১২ বছর আগের শিক্ষাক্রমে ফিরছে প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে নতুন বছরে ছাপা মোট বইয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি ১৬ লাখ। উপরন্তু, গত কয়েক বছরে বিপুল সংখক পাঠ্যবই ভারতে ছাপা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে এবার দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলোই পুরো ছাপার কাজ করছে। সব কিছু গুছিয়ে আওয়ামী আমলের দরপত্র বাতিল করে নতুন করে দরপত্র দেয় সরকার পক্ষ। কিন্তু নানা অজুহাতে মুদ্রণ কাজে প্রেস প্রতিষ্ঠানগুলোর ঢিলেমি প্রকট হয়ে ওঠে। আবার দীপু মনি সিন্ডিকেটের কতিপয় প্রচার মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচার চালানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকের পাঠ্যবই ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ছাপানো শেষ হওয়ার কথা কিন্তু তা হয়নি। এখন পর্যন্ত মুদ্রণ কাজের সার্বিক অগ্রগতি হতাশাজনক। এমনকি কোনো কোনো প্রেস নিম্নমানের কাগজ ও কালিতে বই ছাপতে শুরু করে।
নিম্নমানের কাগজে ছাপানোয় ৮০ হাজার পাঠ্যবই ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ ডিসেম্বর কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ফরাজী প্রেস অ্যান্ড পাবলিকসন্সের নিম্নমানের কাগজে ছাপানো প্রায় ৩০ হাজার কপি প্রাথমিকের পাঠ্যবই হাতেনাতে ধরে বাতিল করে এনসিটিবির মনিটরিং টিম। কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর না মানায় ও উজ্জ্বলতা কম হওয়ায় শোকজও করা হয় ফরাজী প্রেসকে। এর আগে আরো চারটি প্রেসের ৭০ হাজার বই বাতিল করা হয়।